উন্নয়নের দেহা নফার হালুরঘাডর পোল
উন্নয়নের দেহা নফার হালুরঘাডর পোল
ওমর কায়সার: বড় মাছের বড় টুকরোর স্বাদ নিতে নিতে হঠাৎ গলায় কাঁটা বিঁধে গেলে যেরকম হয়, ঠিক তেমনি মেগা মেগা প্রকল্পের খুশির মধ্যে কাঁটার মতো চট্টগ্রামের মানুষদের কষ্ঠ দিচ্ছে কালুরঘাট সেতু। চট্টগ্রামের মানুষ ছড়া কেটে তাই বলে
রসাই রসাই মজা গরি
খাইদ্দি মাছর ঝোল
মরার কেঁডা বাজাই দিলু
হত্ত গন্ডগোল
উন্নয়নর দেহা নঅফার
হালুরঘাডর পোল।
(আমোদ করে, মজা করে
খাচ্ছি মাছের ঝোল মরার
কাঁটা আটকে গিয়ে
হলো যে গণ্ডগোল
উন্নয়নের দেখা পায় না
কালুরঘাটের পুল)
হালুরঘাডর পোল মানে কালুরঘাটের পুল। এটিই এখন লক্ষ লক্ষ মানুষের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৩০ সালে নির্মিত ২১০০ ফুট দীর্ঘ এই সেতুটি নির্মাণের পর ৯২ বছর পেরিয়ে গেছে।প্রতিদিন ঝুঁকি মাথায় নিয়ে লক্ষ লক্ষ লোক এই সেতু ব্যবহার করে।
চট্টগ্রামের বোয়ালখালী, পূর্ব পটিয়া, দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া, চান্দগাঁও ও মোহরা এলাকার প্রায় ২০ লক্ষ মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম এই সেতু। চট্টগ্রামের উন্নয়নের রথে একটিমাত্র অচলায়তেনর নাম এই কালুরঘাট সেতু্।
বিগত বছরগুলোতে চট্টগ্রামের উন্নয়ন তালিকায় যুক্ত হয়েছে বড় বড় অনেক প্রকল্প । এগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু ট্যানেল, কোরিয়ান ইপিজেড, চায়না ইকোনমিক জোন, মহেশখালী ইকোনমিক জোন, মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল, মহেশখালীতে গভীর সমুদ্রবন্দর, মহেশখালী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, বাঁশখালীতে এস আলম গ্রুপের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন প্রকল্প, কক্সবাজার বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীতকরণ প্রকল্প, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কপথ চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্প, চট্টগ্রাম শহরের লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত দীর্ঘ উড়ালসড়ক এবং চট্টগ্রাম বন্দর বে-টার্মিনাল প্রকল্প উল্লেখযোগ্য ।
নতুন নতুন কাজ হচ্ছে, এক একটা প্রকল্প এক একটা এলাকার চেহারা পাল্টে দিচ্ছে। অথচ নতুন কালুরঘাট সেতু নির্মাণে একের পর এক বাধা আসছে। ফলে ২০ লক্ষ মানুষের হতাশা দিন দিন বাড়ছে। কেননা একমুখি এই সড়কের দীর্ঘ যানজট একটা অসহনীয় পর্যায়ে এসে ঠেকেছে।
কর্ণফুলীর দুই পাড়ের মানুষের এই ভোগান্তি বছরের পর বছর ধরে চলছে। নিষ্টুর নিয়তির মতো অসহায় অবলোকন ছাড়া যেন কিছুই করার নেই। দৈর্ঘ্য অনুযায়ী এই সেতু পার হতে সময় লাগে ১০ মিনিট। কিন্তু কালুরঘাট সেতু পর হাওয়ার জন্য যানবাহনগুলোকে অপেক্ষা করতে হয় এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে।
২০০১ সালে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষিত এই সেতুটিই চট্টগ্রামের দুঃখে পরিণত হয়েছে। এরপর ২০১১ সালেও চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) একদল গবেষক আরেকবার এটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছিলেন। এখন এই ২০২২ সালে এটি আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এখন সেতুর গর্তগুলো বড় হয়েছে আরো। সেই গর্ত দিয়ে নদীর পানির প্রবাহ চোখে পড়ে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় কালুরঘাট সেতুর সংস্কারে আর কাজ হবে না।
এই সেতু বিনির্মাণের কোনো বিকল্প নেই। কারণ রেল কর্তৃপক্ষ ২০১১ সালে চুয়েট ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণার সাত বছর আগে ২০০৪ সালে ১১ মাস সেতুতে চলাচল বন্ধ রেখে একবার বড় ধরনের সংস্কার করেছিল। তাতে ব্যয় হয়েছিল ১০ কোটি টাকা। এত বড় সংস্কারের পরও সেটি ঝুঁকিপূর্ণ থেকে যায়। কর্ণফুলী ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণার পর মানুষের ভোগান্তি লাঘবে এখানে নতুন সেতু নির্মাণের দাবি ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে। সে কারণে নব্বই দশকের শুরু থেকে এই কালুরঘাট সেতু রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। প্রতি নির্বাচনে প্রতিশ্রুতি তালিকায় শীর্ষে তাকে কালুরঘাট। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি কখনো বাস্তবে রূপ পায়নি।
প্রয়াত সাংসদ মঈনুদ্দিন খান বাদল কালুরঘাট সেতু নির্মাণের জন্য একপ্রকার মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। তিনি পারেননি। সেতুর স্বপ্ন নিয়ে তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। বর্তমান সাংসদ আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা মোছলেম উদ্দিন আহমদও চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু বার বার নানা সিদ্ধান্তহীনতায় এটি আর বাস্তবের মুখ দেখছে না। কালুরঘাট সেতু প্রকল্প গ্রহণের সর্বশেষ বাধা ছিল এই উচ্চতা নির্ধারণে জটিলতা। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ৭দশমিক ২ মিটার উচ্চতায় কালুরঘাট সেতু স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ–পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এটার উচ্চতা ১২ দশমিক ২ মিটার উচ্চতায় করার দাবি জানায়।
শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে বিআইডব্লিউটিএর কথাই রাখা হলো। বর্তমানে একটি কোরীয় কোম্পানি এই উচ্চতায় রেল কাম সড়ক সেতু নির্মাণের ফিজিবিলিট স্টাডি চলছে। আগামী মে মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। এই স্টাডি শেষ হওয়ার পর এটি একনেকে পেশ করা হবে। তবে কবে এই প্রকল্প পাশ হবে, কখন সেতুটি নির্মিত হবে তা অনিশ্চিত। কিন্তু এই কালুরঘাট সেতুর এই বেহাল অবস্থা একটি বিশাল এলাকাকে এই উন্নয়নের যুগেও ৫০ বছর পিছিয়ে রেখেছে।
গত রোববার (৩০ জানুয়ারি ) সেতুটির ওপর দোহাজারিমুখি একটি ট্রেনের তলায় এক প্রবীণ লোকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। লোকটির ছিন্নভিন্ন দেহ ছড়িয়ে পড়ে সেতুতে। এরপর দুই পাশে যানচলাচল বন্ধ থাকে একঘন্টার বেশি সময়। আর কর্ণফুলীর দুই তীরে দুই পাড়ের হাজারো মানুষের হাহাকার নদী পেরুনোর জন্য। শুধ মানুষের মৃত্যু বলে নয়, সড়কের খানাখন্দে গাড়ি আটকে গিয়ে কিংবা মাঝপথে গাড়ি অচল হয়ে এরকম নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় প্রায় সময়। এ ছাড়া সেতুটি দিয়ে প্রতিদিন চট্টগ্রাম–দোহাজারি রুটের দুই জোড়া ট্রেন আসা যাওয়া করে। এসময়ও সড়ক পথের গাড়ি পারাপার বন্ধ থাকে।
তখন যানজটের দৈর্ঘ্য এককিলোমিটার ছাড়িয়ে যায়। উন্নয়নের এই জোয়ারের সময় কালুরঘাট সেতু যেন একটা ভাটির টানের নিয়তি। অথচ এই সেতু হলে পুরো একটি জনপদের চেহারা পাল্টে যাবে। বোয়ালখালী শিল্প এলাকার প্রসার হবে। বোয়ালখালী নিজেই একটা শহরে পরিণত হবে। বহু মানুষ বোয়ালখালিতে বসবাস শুরু করবে। তাতে শহরের ওপর চাপ কমবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ছাড়া একটি এলাকার উন্নয়নের স্বপ্ন মূলত অলিক থেকে যায়। কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন হলে বোয়ালখালীর উদালবুনিয়া সড়ক দিয়ে বান্দরবানের দুরত্ব ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার কমে যাবে।
এতে করে চট্টগ্রাম কক্সবাজার সড়কের ওপর চাপ কমবে। কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন প্রসারণ সার্থক হবে। সব মিলিয়ে চট্টগ্রামের উন্নয়নের সঙ্গে কালুরঘাট সেতু অন্তর্ভুক্ত না হলে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। মানুষের নিত্যদিনের ভোগান্তির কথা ভেবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ কালুরঘাট সেতু নির্মাণে আন্তরিক হবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
(আজ প্রথম আলোর সম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশিত।)
এই রকম আরও তথ্য পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে যুক্ত থাকুন। এর পাশাপাশি গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন।
আপনার মূল মান মতামতটি আমাদের জানান। আমি শালীন ভাষা ব্যাবহার করবো এবং অশ্লীল ভাষা ব্যাবহার থেকে বিরত থাকবো। কৌণিক বার্তা.কম আপনার আইপি অ্যাড্রেস ব্লকের ক্ষমতা রাখে।
comment url